হাম একটি অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাসজনিত রোগ, যা মূলত শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। যদিও এটি ভ্যাকসিনের মাধ্যমে সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এটি এখনও শিশু মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে, প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ শিশু হাম দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই প্রবন্ধে হাম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এবং এর চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায় তুলে ধরা হলো।
হাম কী?
হাম একটি ভাইরাসজনিত সংক্রমণ, যা মরবিলি ভাইরাস দ্বারা ঘটে। এটি সাধারণত শ্বাসতন্ত্রে শুরু হয় এবং দ্রুত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগটি সাধারণত শীতকালীন এবং বসন্তকালে বেশি দেখা যায় এবং যেকোনো বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতে পারে, যদিও শিশুদের ক্ষেত্রে এটি বেশি মারাত্মক।
হাম সংক্রমণের উপায়
হাম প্রধানত এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়ায়। এটি সাধারণত নিম্নলিখিত উপায়ে সংক্রমিত হয়:
শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে:
আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে থাকা ভাইরাসে অন্যরা আক্রান্ত হতে পারে।শারীরিক সংস্পর্শ:
আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের তরল বা দূষিত বস্ত্রের সংস্পর্শে এলে।দূষিত পৃষ্ঠের সংস্পর্শে:
ভাইরাসটি সংক্রামিত পৃষ্ঠে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে, যা স্পর্শ করলে সংক্রমণ ঘটতে পারে।
হাম রোগের লক্ষণ
হামের লক্ষণগুলো সংক্রমণের ১০-১৪ দিনের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। প্রধান লক্ষণগুলো হলো:
প্রাথমিক লক্ষণ:
- জ্বর (মাঝারি থেকে উচ্চ তাপমাত্রা)
- কাশি
- নাক দিয়ে পানি পড়া
- চোখ লাল হওয়া এবং চোখে জ্বালা
কপলিক দাগ:
মুখের ভেতরে, বিশেষ করে গালের ভেতরের অংশে ছোট সাদা দাগ দেখা যায়, যা হাম সনাক্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন।ত্বকের ফুসকুড়ি:
সংক্রমণের কয়েক দিন পরে সারা শরীরে লাল ফুসকুড়ি দেখা যায়, যা প্রথমে মুখ থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে নিচের দিকে ছড়ায়।
হাম রোগের জটিলতা
যদিও হাম সাধারণত স্বল্প-মেয়াদি রোগ, এটি গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত শিশুদের মধ্যে। সম্ভাব্য জটিলতাগুলোর মধ্যে রয়েছে:
নিউমোনিয়া:
ফুসফুসে সংক্রমণ, যা মারাত্মক হতে পারে।ডায়রিয়া এবং পানিশূন্যতা:
শিশুদের ক্ষেত্রে এটি প্রাণঘাতী হতে পারে।এনসেফালাইটিস:
মস্তিষ্কে প্রদাহ, যা স্থায়ী স্নায়বিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।কর্ণপাত:
হাম সংক্রমণের কারণে কিছু শিশু স্থায়ী শ্রবণ শক্তি হারাতে পারে।গর্ভাবস্থার সমস্যা:
গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে হাম গর্ভপাত বা সময়ের আগে সন্তান প্রসবের ঝুঁকি বাড়ায়।
হাম রোগের চিকিৎসা
হামের জন্য নির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই, তবে লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর অবস্থার উন্নতি করা যায়।
পুষ্টিকর খাদ্য:
রোগীকে পুষ্টিকর খাদ্য এবং প্রচুর পানি সরবরাহ করা জরুরি।ভিটামিন এ সাপ্লিমেন্ট:
ভিটামিন এ-এর অভাব হামের জটিলতা বাড়াতে পারে। তাই এটি রোগীদের মধ্যে নিয়মিতভাবে প্রদান করা হয়।জ্বর কমানোর ওষুধ:
প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন দিয়ে জ্বর এবং ব্যথা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।নাক পরিষ্কার রাখা:
নাক দিয়ে পানি পড়া এবং কাশির জন্য বাষ্প গ্রহণ বা নাসাল ড্রপ ব্যবহার করা যেতে পারে।মেডিক্যাল পর্যবেক্ষণ:
গুরুতর সংক্রমণের ক্ষেত্রে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন হতে পারে।
হাম প্রতিরোধের উপায়
হাম প্রতিরোধে ভ্যাকসিন সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। এছাড়া সচেতনতা বাড়িয়ে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই রোগটি প্রতিরোধ করা সম্ভব।
এমএমআর ভ্যাকসিন:
হাম, মাম্পস, এবং রুবেলার জন্য একত্রে প্রয়োগ করা ভ্যাকসিন। এটি শিশুদের ৯-১২ মাস এবং ১৫-১৮ মাস বয়সে দেওয়া হয়।জনসচেতনতা:
হামের লক্ষণ ও প্রতিরোধ সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা প্রয়োজন।সংক্রমিত ব্যক্তিদের আইসোলেশন:
সংক্রমিত ব্যক্তিদের অন্যদের থেকে আলাদা রাখা উচিত।পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা:
বাড়ি এবং আশপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা এবং সংক্রমিত ব্যক্তির ব্যবহার করা জিনিসপত্র জীবাণুমুক্ত করা।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
উন্নয়নশীল দেশগুলিতে দারিদ্র্য, অপুষ্টি, এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার অভাবের কারণে হাম এখনো একটি বড় সমস্যা। সঠিক সময়ে ভ্যাকসিনেশন এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা সহজলভ্য করার মাধ্যমে এই রোগটি সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা সম্ভব।
উপসংহার
হাম একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ, যার বিরুদ্ধে সঠিক সময়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করলে জটিলতা এড়ানো সম্ভব। ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচি আরও প্রসারিত করে এবং জনসচেতনতা বাড়িয়ে আমরা এই রোগের বিস্তার রোধ করতে পারি। একটি সুস্থ ও নিরাপদ সমাজ গড়তে, প্রতিটি শিশুকে হাম মুক্ত রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
0 Comments