প্রস্রাবনালী সংক্রমণ (Urinary tract infections -UTIs): কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

 

প্রস্রাবনালী সংক্রমণ বা ইউটিআই (Urinary Tract Infection) হলো প্রস্রাবনালীতে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট একটি সংক্রমণ। এটি পুরুষ ও মহিলাদের উভয়ের মধ্যেই দেখা যায়, তবে মহিলারা তুলনামূলকভাবে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। সময়মতো চিকিৎসা না করলে ইউটিআই কিডনি পর্যন্ত সংক্রমণ ছড়িয়ে বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

এই প্রবন্ধে আমরা ইউটিআই-এর কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা, এবং প্রতিরোধ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

ইউটিআই কী?

ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (ইউটিআই) হলো প্রস্রাবনালীর বিভিন্ন অংশে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ। সাধারণত এটি নিম্নলিখিত অংশগুলোতে হতে পারে:

  1. মূত্রাশয় (সিস্টাইটিস): মূত্রাশয়ের সংক্রমণ।
  2. মূত্রনালী (ইউরেথ্রাইটিস): মূত্রনালীর সংক্রমণ।
  3. কিডনি (পাইলোনেফ্রাইটিস): কিডনিতে ছড়িয়ে পড়া সংক্রমণ।

ইউটিআই-এর কারণ

ইউটিআই-এর প্রধান কারণ হলো ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে Escherichia coli (E. coli) ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালীতে প্রবেশ করে এবং সংক্রমণ ঘটায়। অন্যান্য কারণগুলো হলো:

  1. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব:

    • প্রস্রাবের পর সঠিকভাবে পরিষ্কার না করা।
    • অপরিচ্ছন্ন টয়লেট ব্যবহার।
  2. মূত্রত্যাগে বাধা:

    • দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্রাব আটকে রাখা।
    • মূত্রনালীর কোনো বাধা (যেমন কিডনি পাথর)।
  3. অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা:

    • ডায়াবেটিস।
    • ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হওয়া।
    • প্রস্টেট গ্রন্থি বৃদ্ধি (পুরুষদের ক্ষেত্রে)।
  4. অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন:

    • পর্যাপ্ত পানি না খাওয়া।
    • যৌনমিলনের সময় পরিচ্ছন্নতা না বজায় রাখা।

ইউটিআই-এর লক্ষণ

ইউটিআই-এর লক্ষণ সংক্রমণের তীব্রতা ও অবস্থানের উপর নির্ভর করে।

সাধারণ লক্ষণ:

  • প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া বা ব্যথা।
  • ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রয়োজন।
  • প্রস্রাবের রং মেঘলা বা রক্তমিশ্রিত।
  • প্রস্রাব থেকে তীব্র দুর্গন্ধ।
  • তলপেটে বা কোমরের একপাশে ব্যথা।

উপরের প্রস্রাবনালী সংক্রমণের লক্ষণ (কিডনি সংক্রমণ):

  • উচ্চ তাপমাত্রায় জ্বর।
  • ঠান্ডা লাগা বা কাঁপুনি।
  • কোমরে তীব্র ব্যথা।
  • বমি বা বমি বমি ভাব।

ইউটিআই-এর নির্ণয়

ইউটিআই নির্ণয়ের জন্য নিম্নলিখিত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়:

১. শারীরিক পরীক্ষা:

  • চিকিৎসক প্রস্রাবনালী ও তলপেটে ব্যথা এবং সংক্রমণের লক্ষণ পরীক্ষা করেন।

২. প্রস্রাব পরীক্ষা (ইউরিন অ্যানালাইসিস):

  • প্রস্রাবে ব্যাকটেরিয়া, রক্ত বা পুঁজের উপস্থিতি শনাক্ত করা।

৩. প্রস্রাব কালচার:

  • নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া সনাক্ত করে এর বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক নির্ধারণ করা।

৪. ইমেজিং টেস্ট:

  • বারবার ইউটিআই হলে আল্ট্রাসাউন্ড বা সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে মূত্রনালী বা কিডনির কোনো অস্বাভাবিকতা পরীক্ষা করা।

ইউটিআই-এর চিকিৎসা

ইউটিআই-এর চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য সহায়ক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

১. অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি:

  • ইউটিআই-এর চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক সবচেয়ে কার্যকর।
  • সাধারণত ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক:
    • সিপ্রোফ্লক্সাসিন।
    • নাইট্রোফিউরানটোইন।
    • অ্যামোক্সিসিলিন।
  • চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স সম্পূর্ণ করা অত্যন্ত জরুরি।

২. ব্যথা ও জ্বালাপোড়ার চিকিৎসা:

  • প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন জ্বর ও ব্যথা কমাতে সহায়ক।
  • পর্যাপ্ত পানি পান করা সংক্রমণমুক্ত হতে সাহায্য করে।

৩. গুরুতর সংক্রমণ:

  • কিডনি সংক্রমণের ক্ষেত্রে ইনজেকশনের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হতে পারে।
  • হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন হতে পারে।

প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা

ইউটিআই থেকে রক্ষা পেতে কিছু প্রতিরোধমূলক পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে:

১. পর্যাপ্ত পানি পান করা:

  • প্রতিদিন কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন। এটি প্রস্রাবের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া দূর করতে সাহায্য করে।

২. প্রস্রাবের সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা:

  • প্রস্রাবের পর সামনে থেকে পিছনের দিকে পরিষ্কার করুন।

৩. প্রস্রাব আটকে না রাখা:

  • প্রস্রাব আটকে রাখলে ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি পেতে পারে।

৪. সঠিক খাদ্যাভ্যাস:

  • প্রচুর ফল এবং সবজি খান।
  • ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার (যেমন কমলা, লেবু) ইউটিআই প্রতিরোধে সহায়ক।

৫. যৌনমিলনের সময় সতর্কতা:

  • যৌনমিলনের আগে ও পরে প্রস্রাব করুন।
  • সঠিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করুন।

ইউটিআই-এর সম্ভাব্য জটিলতা

সঠিক চিকিৎসা না হলে ইউটিআই গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যেমন:

  1. কিডনি সংক্রমণ: কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
  2. সেপ্টিসেমিয়া: সংক্রমণ রক্তে ছড়িয়ে পড়ে।
  3. গর্ভাবস্থায় জটিলতা: প্রসবকালীন সমস্যা হতে পারে।

উপসংহার

প্রস্রাবনালী সংক্রমণ (ইউটিআই) একটি সাধারণ সমস্যা হলেও সঠিক সচেতনতা এবং সময়মতো চিকিৎসা না হলে এটি গুরুতর সমস্যায় পরিণত হতে পারে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, সঠিক পরিচ্ছন্নতা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ইউটিআই থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

ইউটিআই-এর লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সঠিক চিকিৎসা এবং সচেতনতাই ইউটিআই থেকে মুক্তির মূল চাবিকাঠি।

Post a Comment

0 Comments