স্ট্রেপ থ্রোট: কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

 

স্ট্রেপ থ্রোট একটি সাধারণ কিন্তু তীব্র সংক্রমণ যা গলায় ব্যথা ও অস্বস্তি সৃষ্টি করে। এটি সাধারণত ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয় এবং প্রায়শই শিশু ও কিশোরদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। তবে, যে কোনো বয়সের মানুষ এতে আক্রান্ত হতে পারে। স্ট্রেপ থ্রোটের সঠিক এবং সময়মতো চিকিৎসা না হলে এটি জটিলতায় পরিণত হতে পারে।

এই প্রবন্ধে আমরা স্ট্রেপ থ্রোটের কারণ, লক্ষণ, নির্ণয়, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

স্ট্রেপ থ্রোট কী?

স্ট্রেপ থ্রোট হলো গলার সংক্রমণ যা Streptococcus pyogenes বা গ্রুপ এ স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। এটি অত্যন্ত সংক্রামক এবং এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে সহজেই ছড়াতে পারে।

স্ট্রেপ থ্রোটের কারণ

স্ট্রেপ থ্রোটের প্রধান কারণ হলো গ্রুপ এ স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া। এটি সাধারণত ছড়ায়:

  1. হাঁচি বা কাশির সময় বাতাসে ছড়ানো ড্রপলেটের মাধ্যমে।
  2. সংক্রামিত ব্যক্তির স্পর্শ বা তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র (তোয়ালে, খাবারের বাসন) ব্যবহার করার মাধ্যমে।
  3. পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে।

স্ট্রেপ থ্রোটের লক্ষণ

স্ট্রেপ থ্রোটের লক্ষণগুলি সাধারণত সংক্রমণের দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে প্রকাশ পায়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

গলার সমস্যাগুলি:

  • তীব্র গলা ব্যথা।
  • কথা বলতে বা গিলতে অসুবিধা।
  • গলার লালচে হওয়া এবং সাদা বা হলুদ পুঁজযুক্ত প্যাচ দেখা।

সাধারণ লক্ষণগুলি:

  1. হঠাৎ উচ্চ জ্বর (১০১°F বা তার বেশি)।
  2. গলা ফোলা এবং টনসিল বড় হয়ে যাওয়া।
  3. ঘাড়ে লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া।
  4. মাথাব্যথা এবং পেশীতে ব্যথা।
  5. ক্ষুধামন্দা এবং ক্লান্তি।

শিশুদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত লক্ষণ:

  • বমি বা পেট ব্যথা।
  • অস্বাভাবিক মেজাজ বা ঝিমঝিম ভাব।

স্ট্রেপ থ্রোটের নির্ণয়

স্ট্রেপ থ্রোট সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য নিম্নলিখিত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়:

১. শারীরিক পরীক্ষা:

  • গলার অবস্থা, টনসিলের আকার এবং ফুলে যাওয়া গ্রন্থি পর্যবেক্ষণ।

২. র‍্যাপিড স্ট্রেপ টেস্ট (RST):

  • গলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করা।
  • দ্রুত ফলাফল পাওয়া যায় (২০ মিনিটের মধ্যে)।

৩. গলা কালচার টেস্ট:

  • RST নেগেটিভ হলে এই টেস্ট করা হয়।
  • ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করার জন্য প্রায় ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগে।

স্ট্রেপ থ্রোটের চিকিৎসা

স্ট্রেপ থ্রোটের চিকিৎসায় প্রধানত অ্যান্টিবায়োটিক এবং উপশমমূলক ওষুধ ব্যবহার করা হয়।

১. অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি:

স্ট্রেপ থ্রোট ব্যাকটেরিয়ার কারণে হওয়ায় অ্যান্টিবায়োটিক সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা।

  • সাধারণত ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক:
    • পেনিসিলিন।
    • অ্যামোক্সিসিলিন।
    • ইরিথ্রোমাইসিন (যদি রোগী পেনিসিলিনে অ্যালার্জি থাকে)।
  • অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স সম্পূর্ণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি লক্ষণ ভালো হয়ে গেলেও।

২. ব্যথা ও জ্বরের জন্য ওষুধ:

  • প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • এটি গলার ব্যথা, মাথাব্যথা এবং জ্বর কমাতে সাহায্য করে।

৩. উপশমমূলক পদ্ধতি:

  • কুসুম গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে কুলকুচি করা।
  • গরম চা বা মধু মিশ্রিত গরম পানি পান করা।
  • ঠান্ডা বা অ্যাসিডিক খাবার এড়িয়ে চলা।

৪. বিশ্রাম:

  • পূর্ণ বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন।
  • শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে।

স্ট্রেপ থ্রোটের জটিলতা

সময়মতো চিকিৎসা না করলে স্ট্রেপ থ্রোট থেকে নিম্নলিখিত জটিলতা হতে পারে:

  1. রিউমাটিক জ্বর: হৃদপিণ্ড ও জয়েন্টে প্রদাহ।
  2. গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস: কিডনিতে প্রদাহ।
  3. টনসিল অ্যাবসেস: টনসিলের চারপাশে পুঁজ জমা।
  4. সাইনুসাইটিস এবং কানের সংক্রমণ।

স্ট্রেপ থ্রোট প্রতিরোধের উপায়

১. ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা:

  • নিয়মিত হাত ধোয়া।
  • মুখে হাত দেওয়া এড়িয়ে চলা।

২. সংক্রামিত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়ানো:

  • স্ট্রেপ থ্রোট আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে সরাসরি শারীরিক সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।

৩. সঠিক চিকিৎসা:

  • চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চিকিৎসা গ্রহণ।
  • সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধে অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পূর্ণ করা।

৪. শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা:

  • স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা।
  • পর্যাপ্ত ঘুম এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা।

উপসংহার

স্ট্রেপ থ্রোট একটি সাধারণ কিন্তু সংক্রামক ব্যাধি যা সঠিক সময়ে নির্ণয় এবং চিকিৎসার মাধ্যমে সহজেই নিরাময় করা সম্ভব। গলা ব্যথা বা জ্বরের মতো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। পাশাপাশি, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার মাধ্যমে এই রোগের ঝুঁকি কমানো যায়।

স্ট্রেপ থ্রোটের বিষয়ে সচেতনতা এবং সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণই হলো এর সেরা প্রতিরোধ।

Post a Comment

0 Comments